পাম্পে তেল প্রতারণা

ডেস্ক রিপোর্ট • রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের রাস্তায় প্রতিদিন চলছে হাজার হাজার বাস-ট্রাক-প্রাইভেট কার-মোটরবাইক। এসব যানবাহন চলে ডিজেল-পেট্রল-অকটেন আর সিএনজিতে। পাম্পে ডিজেল-পেট্রল-অকটেন নিতে গিয়ে নিত্যদিন প্রতারণার শিকার হচ্ছেন এসব যানবাহনের মালিক-চালকরা। ঢাকাসহ দেশের বেশির ভাগ পাম্পে কোথাও ভেজাল তেল; কেউ ওজনে কম দিচ্ছেন। বিএসটিআই’র সরেজমিন পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এই চিত্র উঠে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক দিকে যানবাহনের মালিক দামে ঠকছেন, অন্যদিকে ভেজাল তেলের কারণে তাদের বাহনের ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ পেট্রল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতারাও স্বীকার করে বলেছেন, রাজধানী ঢাকাসহ জেলা ও উপজেলায় পাম্পগুলোতে ওজনে একটু কম দেয়া হয়। বিএসটিআই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বেশ কিছু ত্রæটিপূর্ণ পাম্প পেয়েছে।

ওজনে কম দেয়া নিয়ে বিএসটিআই’র আইনে বলা হয়েছে, জ্বালানি তেল ওজনে কম দিলে অনূর্ধ্ব ১০ হাজার টাকা জরিমানা এবং প্রতিটি অপরাধের জন্য অর্থদন্ডসহ ৩ বছরের কারাদন্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু আইনে থাকলেও তা কার্যকর করা হচ্ছে না বলে গাড়ির মালিকদের অভিযোগ।

জানতে চাইলে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম ইনকিলাবকে বলেন, তেল চুরি ঠেকাতে আসলে কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি। পাম্পে তেল বিক্রিতে ওজনে কম দেয়া হচ্ছে। পরে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হয়। এর পরে আর কিছু হচ্ছে না। ভেজাল রোধে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা কার্যকর করা উচিত।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সারাদেশে ২ হাজার ৩০০টি তেলের পাম্প রয়েছে। এর মধ্যে ৫৬৬টি অনুমোদিত ও ১০৩টি অনুমোদনহীন। এসব পাম্পে প্রতিদিন গড়ে ৫৬ লিটার অকটেন ও ৫০ লিটার ডিজেল ও পেট্রল ওজনে কম দেয়া হচ্ছে। এতে করে মাসে ৫০-৬০ লাখ টাকা গ্রাহকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন পাম্প মালিকরা। পাম্পে জ্বালানি তেল বিক্রিতে ওজনে কম দেয়া হচ্ছে। গত সেপ্টেম্বর মাসে ৩৫০টি পাম্প সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে সংস্থার পরিদর্শন টিম। এর মধ্যে ২৩৯টি পাম্প মানসম্মত অকটেন সরবরাহ করলেও তিনটিতে ভেজাল মিলেছে। আর ২০-৩০টি মানসম্মত পেট্রল বিক্রি করছে না। পরে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হয়। একই সাথে ভেজাল জ্বালানি তেলের কারণে হাজার হাজার গাড়ির ইঞ্জিন বিকল হচ্ছে। ওজনে কম দেয়া এবং ভেজাল রোধে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। এ দিকে রাজধানীর পাম্পগুলো তেলের মান নিয়ন্ত্রণ দেখার দায়িত্ব বিএসটিআই’র। তাদের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তাদের কারণে পাম্পগুলো এ অনিয়ম করে। তবে মাসোয়ারার টাকা না দিলে বিএসটিআই অভিযানে নামে। আর টাকা দিলে অভিযান বন্ধ রাখে বিএসটিআই বলে অভিযোগ পাম্প মালিক সমিতির নেতাদের।

বিএসটিআই’র মহাপরিচালক মো. মুয়াজ্জেম হোসাইন ইনকিলাবকে বলেন, দেশের সাধারণ ভোক্তারা তেল ও অকটেন নিতে যেন হয়রানির শিকার না হয় সেজন্য আমরা নিয়মিতভাবে তেল পাম্পগুলোতে অভিযান পরিচালনা করছি। অনেক সময় যদি গ্রাহকরা আমাদের কাছে অভিযোগ দেন। তবে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে অভিযোগের ভিত্তিতে তেলপাম্পে অভিযান চালিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করে থাকি এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়।

দেশে মানহীন ভেজাল জ্বালানি তেল বিক্রির পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। প্রতিনিয়ত গ্রাহকরা ঠকছেন পেট্রলপাম্পগুলো থেকে তেল নিয়ে। ফিলিং স্টেশনগুলোয় ওজনে কম ও ভেজাল তেল দেয়া যেন স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। এসব বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেই সংশ্লিষ্ট সংস্থার। হঠাৎ হঠাৎ দু-একটি অভিযান পরিচালনা করলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় তেল বিক্রিতে প্রতারণা বন্ধ হচ্ছে না। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) গত অক্টোবরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার পর পেট্রল পাম্পের মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। এগুলো হচ্ছেÑ রাজধানীর মিরপুর-২ শাহআলীবাগ এলাকার পেট্রলপাম্প মেসার্স স্যাম এসোসিয়েটস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিদিন গড়ে আনুমানিক ৩৬ হাজার লিটার পেট্রল, অকটেন ও ডিজেল বিক্রি করে থাকে। ঢাকা মহানগরীর উত্তরা ও গাজীপুর এলাকায় বিএসটিআই অভিযান পরিচালনা করে আরো ৩টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। অভিযুক্ত ৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উত্তরার আজমপুর এলাকার মেসার্স কসমো ফিলিং স্টেশন এন্ড সার্ভিস সেন্টার। প্রতিষ্ঠানটির দু’টি অকটেন ডিসপেন্সিং ইউনিটে প্রতি ১০ লিটারে ১৪০ মিলি লিটার অকটেন ও চারটি ডিজেল ডিসপেন্সিং ইউনিটে প্রতি ১০ লিটারে ১৫০ মিলি লিটার, ১২০ মিলিলিটার, ১৯০ মিলিলিটার ও ২০০ মিলিলিটার ডিজেল কম প্রদান করা হয়। একই প্রতিষ্ঠান দু’টি সুপারটেক ও দু’টি হাইটেক ডিসপেন্সিং ইউনিট বিএসটিআই’র সিলবিহীন অবৈধভাবে ব্যবহার করে আসছে।
উত্তরা তুরাগ এলাকার মেসার্স লতিফ এন্ড কোং ফিলিং স্টেশন অকটেন ইউনিটে প্রতি ১০ লিটারে ৩১০ মিলিলিটার এবং দু’টি ডিজেল ইউনিটে প্রতি ১০ লিটারে ১৬০ মিলিলিটার ও ১৭০ মিলিলিটার তেল কম প্রদান করা হয়। গাজীপুরের চন্দ্রা এলাকার মেসার্স মুন স্টার ফিলিং স্টেশনের একটি অকটেন ও একটি ডিজেল ইউনিটে প্রতি ১০ লিটারে ৬০ মিলিলিটার ও ৭০ মিলিলিটার তেল কম প্রদান এবং চারটি গিলবার্কো ডিসপেন্সিং ইউনিট বিএসটিআই’র সিলবিহীন অবৈধভাবে ব্যবহার করে আসছে।

গত ২০ অক্টোবর মিরপুর এলাকার মেসার্স পূর্বাচল গ্যাস ফিলিং অকটেন ডিসপেন্সিং ইউনিটে প্রতি ১০ লিটারে গ্রহণযোগ্য মাত্রার অতিরিক্ত ৪৪০ মিলিলিটার বেশি প্রদান করায় মেসার্স রহমান সার্ভিস স্টেশন দু’টি অকটেন ডিসপেন্সিং ইউনিটে প্রতি ১০ লিটারে ৯০ মিলিলিটার ও ১১০ মিলিলিটার কম প্রদান করায় এবং মেসার্স আল মোসাফির ভেরিফিকেশন সনদ গ্রহণ ব্যতীত ডিজিটাল স্কেল ব্যবহার করায় প্রতিষ্ঠান তিনটির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়।

ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ওজন ও পরিমাপে কারচুপির অপরাধে তেজগাঁও, আমিনবাজার ও গাবতলী এলাকায় ৩টি প্রেট্রল পাম্পের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং ৬০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। অভিযুক্ত ৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তেজগাঁও এলাকার মেসার্স সততা এন্ড কোং ১টি অকটেন ও ২টি ডিজেল ডিসপেন্সিং ইউনিটে প্রতি ১০ লিটারে ৬০, ৭০ ও ৬০ মিলিলিটার কম প্রদান করায় এবং আমিনবাজার এলাকার মেসার্স চিশতিয়া ফিলিং স্টেশনের ৩টি ডিজেল ও ১টি অকটেন আন্ডার গ্রাউন্ড স্টোরেজ ট্যাংকের হালনাগাদ ক্যালিব্রেশন চার্ট না থাকায় ও গাবতলী এলাকার মেসার্স নূর ডিজেল পাম্প ফিলিং স্টেশন এর নন স্ট্যান্ডার্ড/নন ম্যাট্রিক ক্যালিব্রেশন চার্টের ব্যবহার করায় প্রতিষ্ঠান ৩টির প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা আদায় করা হয়।

এছাড়া উত্তরা ও গাজীপুর এলাকায় বিএসটিআই অভিযান পরিচালনা করে ৪টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। অভিযুক্ত ৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উত্তরা আব্দুল্লাপুর এলাকার মেসার্স তাসিন সিএনজি ফিলিং স্টেশন ০১টি অকটেন ডিসপেন্সিং ইউনিটে প্রতি ১০ লিটারে ৫০ মিলিলিটার কম প্রদান করায় এবং গাজীপুর এলাকার মেসার্স স্টার ফিলিং স্টেশন পেট্রল, অকটেন ও ডিজেল ডিসপেন্সিং ইউনিটে প্রতি ১০ লিটারে ৪০ মিলিলিটার, ৫০ মিলিলিটার ও ৫০ মিলিলিটার কম প্রদান, একটি পেট্রল, অকটেন ও ডিজেল ডিসপেন্সিং ইউনিট সিলবিহীন অবস্থায় ব্যবহার ও ৪টি ডিজেল ডিসপেন্সিং ইউনিট সিল ভাঙা অবস্থায় পাওয়া যায়।

এছাড়া একই এলাকার মেসার্স রাজ ফিলিং স্টেশন ডিজেল ইউনিটে প্রতি ১০ লিটারে ১৩০ মিলি লিটার বেশি প্রদান করায় এবং মেসার্স আহম্মেদ ফিলিং এন্ড সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনের হাইটেক ব্র্যান্ডের ৪টি ডিজেল ডিসপেন্সিং ইউনিট সিলবিহীন অবস্থায় ব্যবহার, দু’টি স্টোরেজ ট্যাংকের মেয়াদোত্তীর্ণ চার্ট ব্যবহার করায় প্রতিষ্ঠান চারটির বিরুদ্ধে ওজন ও পরিমাপ মানদন্ড আইন-২০১৮ অনুযায়ী মামলা দায়ের করা হয়। নানা অনিয়মের কারণে এসব পেট্রলপাম্প সাময়িক বন্ধ করে দিলেও কিছুদিন পর আবারও চালু করে দিয়েছে বিএসটিআই। গত দুই বছর আগে সংসদীয় কমিটি জ্বালানি তেলের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে গঠিত কমিটি ১২টি সুপারিশ করেছিল। নির্ধারিত সময়ে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারেনি বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। অনেক সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা জ্বালানি তেল বিক্রিতে ওজনে কম দেয়া।

মিরপুর এলাকার মেসার্স পূর্বাচল গ্যাস ফিলিং অকটেন ম্যানেজার ইনকিলাবকে জানান, তার পাম্পে প্রতিদিন অকটেন, পেট্রল ও ডিজেল বিক্রি হয় ১৫ থেকে ১৬ হাজার লিটার। আবার কখনো কখনো ২ হাজার লিটার থেকে তিন হাজার লিটারও বিক্রি হয়ে থাকে। এর মধ্যে ডিজেল বিক্রি হয় বেশি।

অপরদিকে, বিএসটিআই’র ওজন ও পরিমাপ (মেট্রোলজি) বিভাগ বলছে, ওজনে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে শাহিল ফিলিং স্টেশন প্রতি ১০ লিটার অকটেনে ৫০ মি.লি. গ্রাহকদের কম দিচ্ছে। একইভাবে ডিজেল প্রতি ১০ লিটারে ৫০ মি.লি. কম দেয়া হচ্ছে। মাসে দাঁড়ায় ডিজেল ২৮ লিটার ও অকটেন ৪৫ লিটার। এর মধ্যে ডিজেল বিক্রি বাবদ গ্রাহকদের কাছ থেকে ১৮ হাজার ২০০ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন ওই পাম্পের মালিক। জালিয়াতির এ ঘটনা ধরা পড়ার পর বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ওজন ও পরিমাপ অধ্যাদেশ ১৯৮২ এবং সংশোধনী অ্যাক্ট ২০০১ সালের আইনে মামলা দিয়েছে।

মোটরবাইক চালক ইসমাইল হোসেন সরকার ইনকিলাবকে বলেন, প্রতি মাসে তিন থেকে চারবার পাম্প থেকে তেল নেয়া হয়। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয় তেল কম দেয়া হচ্ছে। কোনো পাম্পের ওজনের সাথে কোনটা মিল পাওয়া যায় না। পাম্প মালিকরা গ্রাহককে ঠগাচ্ছে।

অপরদিকে, জ্বালানি বিভাগে পেট্রল পাম্প ও জ্বালানি তেল বিক্রির বিষয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে জ্বালানি তেলের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে ১২টি সুপারিশ করেছে। সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে- মেরিন বা বার্জ ডিলার নিয়োগে বিপিসির নীতিমালা অনুসরণ করা, ডিলারদের বিপণন কোম্পানি থেকে তেল উত্তোলনের হিসাব রাখা, তেল তোলার আগে কত পরিমাণ তেল ট্যাংকে মজুদ ছিল তার হিসাব রাখা, বার্জের ফ্লো মিটার বিএসটিআই’র মাধ্যমে চেক করা। সভায় কনডেনসেটের দাম পুনঃনির্ধারণ করাসহ বিভিন্ন কারিগরি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে মন্ত্রণালয় সূত্র নিশ্চিত করেছে।